এই বড় ব্যবধানে হারার নিয়মের সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম ছিল ২০২৩ সালে ইংল্যান্ডের ঘরের মাঠের সিরিজটি—যেখানে ইংলিশরা প্রথম দুই ম্যাচে পিছিয়ে পড়ার পর প্রায় ইতিহাস গড়ে সিরিজ জেতার খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিল। সেই অভিজ্ঞতা ইংল্যান্ডের বর্তমান টপ-সিক্সের এখনও সতেজ।
কিন্তু এবারকার সিরিজ ২০২৩ সালের সঙ্গে একেবারেই তুলনীয় নয়। দুই বছর আগে ইংল্যান্ড দুই হারের ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে বেশ কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিল—এজবাস্টন ও লর্ডসে উন্মাদনায় ঠাঁসা, দোলাচলভরা, বারুদমিশ্রিত দুই টেস্টে ইংল্যান্ড প্রতি উইকেটে করেছিল ৩৪.৬ রান, অস্ট্রেলিয়া ৩৫.৮। কিন্তু এবার ইংল্যান্ড প্রতি উইকেটে করেছে মাত্র ২২.৭ রান, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার ৩৮.২, যা ভয়ংকরভাবে মিলে যাচ্ছে ২০২১-২২ (২১.৮ বনাম ৩৯.৫) এবং ২০১৭-১৮ (২৩.৯ বনাম ৩৮.৬) এর পরিসংখ্যানের সঙ্গে।
তবে, ইংল্যান্ডের জন্য সবচেয়ে শঙ্কার জায়গা সিরিজটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়, যেখানে ইংল্যান্ড টানা ১৭টি টেস্ট জিততে ব্যর্থ হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট দেশে ইংল্যান্ডের এর চেয়ে দীর্ঘতর জয়হীন থাকার নজির মাত্র একবারই আছে।
ইংলিশরা পাকিস্তানে ১৯টি টেস্ট জিততে পারেনি, তবে এটির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান হতাশা মিলিয়ে ফেলবার উপায় নেই। পাকিস্তানে চার দশক ধরে—১৯৬১ সালের লাহোর টেস্টে প্রথম জয় থেকে শুরু করে ২০০০ সালের করাচির গোধূলিলগ্নের জয়ের আগ পর্যন্ত মাঝের সময়টা জয়হীন ছিল তারা। আর এই ১৯টির মধ্যে ১৭টি ম্যাচই ছিল ড্র, যার মধ্যে তিনটি সিরিজ পুরোপুরি নিষ্পত্তিহীন। দুই হারের মধ্যে একটি আবার অতি অল্প ব্যবধানে—মাত্র তিন উইকেটে।
এর তুলনায়, অস্ট্রেলিয়ায় ইংল্যান্ডের জয়হীন ধারা অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। ১৭ টেস্টের ১৫টিতেই হেরেছে ইংল্যান্ড, যার মধ্যে মধ্যে তিনটি ইনিংস ব্যবধানে। অস্ট্রেলিয়া যখনই চতুর্থ ইনিংসে লক্ষ্য তাড়া করে জিতেছে, প্রতিবারই ইংল্যান্ড ৮, ৯ অথবা ১০ উইকেটে হেরেছে।
ইংল্যান্ড চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করে যে সাতটি টেস্ট হেরেছে, প্রতিটিতেই হার অন্তত ১২০ রানের ব্যবধানে। দুই ড্রয়ের একটিতে ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত নয় উইকেট হারিয়েছিল, জেমস অ্যান্ডারসন ও স্টুয়ার্ট ব্রড শেষ ওভারগুলো ব্লক করে ম্যাচ বাঁচিয়েছিলেন। এমসিজিতে অন্য ড্রটিতে অস্ট্রেলিয়া খুব আরামে ব্যাট করে ম্যাচ শেষ করে দিয়েছিল।
এসব পরিসংখ্যানের অর্থ এই নয় যে, স্টোকসের ইংল্যান্ডও অতীতের ধারা বজায় রেখে ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হবে—কিন্তু এটি স্পষ্ট করে দেয় যে তাদের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জ কত কঠিন।
এই সিরিজের দুই টেস্টে তারা মোটে ২১৯.১ ওভার ব্যাট করেছে, যা অ্যাশেজে ২-০ পিছিয়ে পড়া কোনো দলের সবচেয়ে কম ওভার মোকাবিলা করার রেকর্ড এবং ২০১৩-১৪ সালে মিচেল জনসনের বিধ্বংসী সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচের চেয়ে প্রায় ৮৫ ওভার কম।
ব্রিসবেনে প্রথমবারের মতো কোনো ‘বাজবল-যুগের’ অ্যাশেজ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ছিল দ্রুত রান করা দল। ইংল্যান্ড ওভারপ্রতি ৩.৭৯ রান করেছে, যা সাধারণ হিসেবে দ্রুত হলেও স্টোকস-ম্যাককালাম যুগ শুরুর পর এটি ইংল্যান্ডের ষষ্ঠ ধীরতম স্কোরিং রেট। কিন্তু তারা নিজেরা দুই টেস্টেই প্রতি ওভারে ৪.৫ রানের বেশি হারে রান খরচ করেছে (পার্থে ৪.৫৭, ব্রিসবেনে ৪.৫৪), যা এই সময়ের ইংল্যান্ডের পঞ্চম ও ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ইকোনমির টেস্ট।
অস্ট্রেলিয়ায় এই গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডের বড় হতাশার জায়গা লোয়ার অর্ডার। যেখানে অস্ট্রেলিয়ার লোয়ার অর্ডার গুরুত্বপূর্ণ রান ও উইকেটে মূল্যবান সময় কাটিয়েছে, ইংল্যান্ডের লোয়ার অর্ডার আবারও দ্রুত ভেঙে পড়েছে। ব্রিসবেনে মিচেল স্টার্ক–স্কট বোল্যান্ডের নবম উইকেট জুটি—যা সিরিজের গতি পাল্টে দেয় এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের লিডকে আধিপত্যে পরিণত করে, ২৭.২ ওভার স্থায়ী হয়েছিল।
ইংল্যান্ডের অষ্টম, নবম ও দশম উইকেট জুটিগুলো দুই টেস্ট মিলিয়ে মোটে ২৭.৫ ওভার টিকেছে—গড়ে প্রতি ১৪ বলে একটি করে উইকেট হারিয়েছে তারা।
কাগজে কলমে সম্ভাবনা ও মাঠের বাস্তবতার ফারাক বুঝতে এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট–গাস অ্যাটকিনসন (১৫ টেস্টে একটি সেঞ্চুরি ও চারটি ৩৫+ ইনিংস) এবং ব্রাইডন কার্স (ভারত সিরিজে তিনটি ৩৫+, কাউন্টিতে ৩০+ গড়, দুটি প্রথম-শ্রেণির শতক)—এই দু’জন পার্থ ও ব্রিসবেনে মোট ৯১ বলে করেছেন ৭৮ ও ৮ রান!
অন্যদিকে টেস্ট নবাগত ব্রেন্ডান ডগেট (ডমেস্টিক গড় ৮.৫) এবং বোল্যান্ড (ডমেস্টিক গড় ১২.১, টেস্টে আগের সেরা স্কোর ২০) ১২৫ বলে করেছেন ৪১ ও ২। অস্ট্রেলিয়া বাজবলের গতিতে রান করেছে, তবে ইংল্যান্ডের বিপরীতে তারা খেলেছে নমনীয়তা, বুদ্ধিমত্তা ও পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা নিয়ে, যা ইংল্যান্ড কেবল ক্ষণিকের জন্যই দেখাতে পেরেছে।
তবে ইতিবাচক দিকও আছে—দুই টেস্ট শেষে ইংল্যান্ডের স্পিন আক্রমণ অস্ট্রেলিয়ার থেকে বেশি উইকেট নিয়েছে। গত ৫০ বছরে অস্ট্রেলিয়ায় যে কোনো অ্যাশেজ সিরিজে প্রথম দুই টেস্টে ইংল্যান্ডের স্পিনাররা যদি অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বেশি উইকেট নেয়, তারা সেই সিরিজ জিতেছে। ২০১০-১১, ১৯৮৬-৮৭ এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে এমনটাই ঘটেছিল।
ব্রিসবেনে যখন উইল জ্যাকস এবারের অ্যাশেজে প্রথম স্পিনার হিসেবে উইকেট নেন (চার বছর আগে স্টিভ স্মিথ ব্রিসবেনে জ্যাক লিচকে আউট করার পর প্রথমবার), ইংল্যান্ড স্পিন-উইকেট তালিকায় ১-০ তে এগিয়ে যায়। ১৯৭৮-৭৯-এ ইংল্যান্ড দুই টেস্ট শেষে ২-০ তে এগিয়ে ছিল এবং বাকি দুই সিরিজেও ১-০ তে এগিয়ে ছিল।
ইংল্যান্ডের জন্য আরেকটু আশার আলো জাগানিয়া তথ্য হচ্ছে শেষবার ইংল্যান্ড অ্যাশেজে প্রথম চার ইনিংসে ৮০ ওভারের কমে অলআউট হয়েছিল ২০০৫ সালে, যেটি তাদের জয়ের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে।
আর ব্রিসবেনে দ্বিতীয় ইনিংসে স্টোকস–জ্যাকসের ৯৬ রানের সপ্তম উইকেট জুটির পর আরেকটা তথ্য উল্লেখ করে হয়–দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়ায় ইংল্যান্ড যখনই সপ্তম উইকেটে ৯০ এর বেশি রান করেছে, তারা অ্যাশেজ জিতেছে (২০১০-১১-তে ইয়ান বেল–ম্যাট প্রিয়র ১০৭, ১৯৭৮-৭৯-এ জিওফ মিলার–বব টেলর ১৩৫)।
এবার দেখা যাক, ইংল্যান্ড ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে পারে নাকি অস্ট্রেলিয়ায় তাদের অসহায় আত্মসমর্পণের ধারা বজায় থাকে।
0 Comments
No Comment YetLeave A Reply